‘ইয়াবা–সুন্দরী’র সাম্রাজ্য বনাম বন্দুকযুদ্ধের ছলনা
গাঁজা ও ফেনসিডিলকে পেছনে ফেলে নেশার দুনিয়ায় ভয়াবহ উন্মাদনা এনেছে অনাগ্রা ও ইয়াবা। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত আট বছরে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে ৭৭ থেকে ১০০ গুণ। প্রথম দিকে মাদকসেবনের মূল ভূমিকায় সচ্ছল ঘরের শিক্ষার্থী, তরুণ, যুবা ও মধ্যবয়সীরা। ইয়াবার বাহক ও গ্রাহকদের মধ্যে একসময় সাড়া জাগিয়েছিল কথিত ‘ইয়াবা–সুন্দরীরা’। ২০০৭ সালের পর থেকে একের পর এক আকর্ষণীয় তরুণী এবং তাদের গডফাদার-মাদারসহ ধরা পড়তে থাকে পুলিশ ও র্যাবের হাতে। সে সময়ই সামাজিক মাধ্যমে ‘ইয়াবা-সুন্দরী’ কথাটা চালু হয়ে যায়। তাদের মাধ্যমে ইয়াবার মোবাইল ফোনভিত্তিক সুলভ বাজার বিস্তৃত হতে থাকে। ফোনের মাধ্যমে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা, নারী ও শিশুদের মাদকের বিক্রেতা ও বাহক বানানোর কৌশলে ইয়াবার আগ্রাসন দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। অল্প সময়ে আর কোনো মাদকের এমন ‘স্মার্ট’ আগ্রাসন আর হয়েছে কি না সন্দেহ।
‘ইয়ো ইয়ো’ থেকে এলেবেলে ‘বস্তির ছেলে’
প্রথম দিকে উচ্চবিত্ত ঘরের বখে যাওয়া ‘ইয়ো ইয়ো’ ছেলেমেয়ে এবং মডেলকন্যা ‘ইয়াবা–সুন্দরী’ভিত্তিক বিপণন দিয়ে শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে এসব সুলভ হয়ে ওঠে। শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত, পরিবহনশ্রমিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় কর্মী ও বস্তির ছেলেদের গণ্ডি পেরিয়ে এখন গ্রামের সন্তানদের নাগালেও পৌঁছে গেছে ইয়াবা, সঙ্গে কিছু সহযোগী মাদকও। মাদক নেওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, বেপরোয়া গাড়ি চালনা, ইভ টিজিং, এমনকি ধর্ষণও। মাদকের বিষে পড়ে গ্রামীণ এলাকা ও শহুরে বস্তিতে ছেলেদের পড়ালেখার গণ্ডি থমকে আছে, কমছে না স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার। যুবসমাজকে ধ্বংসকারী মাদক ইয়াবা ব্যবসার কারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গাড়ির হেলপার, দিনমজুর, পান দোকানি, শিশু শ্রমিক, কিছু রোহিঙ্গা, এমনকি ছোটখাটো ব্যবসায়ী, সাংবাদিকও এখন কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। কোটিপতি হচ্ছেন পুলিশ এবং নারকটিক্স বিভাগের কিছু কিছু লোক।
ছেলেমেয়েরা জানে না তারা পড়ালেখা শেষ করে কী করবে? কী আছে তাদের ভবিষ্যতে? যুবসমাজের সামনে মানবসম্পদ পরিচর্যা ও কর্মসংস্থান তৈরির কোনো স্বচ্ছ লক্ষ্য ও প্রক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি ক্ষমতাসীন সরকার। দখল-লুট, সন্ত্রাস, চাঁদা ও বেপরোয়া অর্থ লোপাট এবং পাশবিক দুর্বৃত্তপনা ও হিংস্রতা দেখে দেখেই বড় হচ্ছে একের পর আরেক প্রজন্ম। জীবিকা অর্জনের প্রায় সব কটি মেধাভিত্তিক ও শ্রমনির্ভর সরল পথও ইচ্ছাকৃত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় কঠিন করে তোলা হয়েছে। অথবা সেসব উপায় একেবারেই রুদ্ধ করে স্বজনপ্রীতি ও ঘুষের বন্দোবস্ত করা আছে।
হতাশাজনক দীর্ঘ বেকারত্ব, উদ্যোক্তা হওয়ার কঠিন পথ পাড়ি দিয়েও ব্যর্থ হওয়ার গ্লানি, গতানুগতিক ব্যবসা কিংবা শেয়ারবাজারে লোকসান করার উপর্যুপরি হতাশা, মানহীন কর্মপরিবেশের ভয়ংকর চাপ ও উৎকণ্ঠা মাদকের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। ম্রিয়মাণ অর্থনীতিতে মধ্য ও নিম্নবিত্তের চাকরি পাওয়ার, চাকরি পেলেও সেখানে ওপরে উঠে আসার আশা কম। বরং সাধারণ মধ্যবিত্ত ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে নিম্নবিত্ত হচ্ছে। যারাই–বা উন্নতি করছে, তাদেরও দিতে হচ্ছে চড়া মূল্য। অবসরহীন পরিশ্রম, একঘেঁয়ে জীবন, শুকিয়ে আসা পারিবারিক জীবনে ক্লান্ত মানুষ রাসায়নিক সুখে মুক্তি খুঁজবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক।
অপরাধপ্রবণ সমাজে কুসঙ্গের হাতছানি তো আছেই। সঙ্গে আছে কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজের চাপ, দীর্ঘ শ্রমঘণ্টা, মানহীন কাজের পরিবেশ, দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্ব, ব্যবসার কঠিন প্রতিযোগিতা ও স্বল্প লাভের পেরেশানি। আছে দিনযাপনের ক্লান্তি ও কষ্ট, কম উপার্জনের হতাশা, পারিবারিক টানাপোড়েন, বিশ্বাসহীন সামাজিক বন্ধন। এমন বহুবিধ কারণে মাদকের বিস্তার সর্বগ্রাসী হয়ে উপস্থিত হয়েছে। এ অবস্থায় সরকার প্রশাসন ও সমাজের বেশির ভাগ লোকের একসঙ্গে জেগে ওঠা দরকার।
প্রতিবেশীদের মাদক সাম্রাজ্য বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ দরকার
দেশের তারুণ্যনির্ভর উৎপাদনমুখিতা যে কয়েকটি ভয়ংকর কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তার মধ্যে মাদক অন্যতম। তরুণ জনসংখ্যাধিক্যের (ডেমোগ্রাফিক ডেভেডিন্ট) বাংলাদেশের কর্মক্ষমতা মাদকে অপচয় হওয়া এক জাতীয় ক্ষতি। আর এ ক্ষতির কারণ ও সুবিধাভোগী হলো, ১. প্রতিবেশী দেশগুলোর মাদক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক কৌশলী গোষ্ঠী, ২. আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়া চক্র এবং (৩) দেশীয় মাদক ব্যবসায়ী-তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকদের ছড়ানো নেটওয়ার্ক। এই তিনে মিলে মাদক ব্যবসার পোক্ত কাঠামো তৈরি করে ফেলেছে। মিয়ানমার ও ভারতীয় মাদকসাম্রাজ্য প্রথমে বাংলাদেশের যুবসমাজকে টার্গেট করে সফল হওয়ার পর প্রসারিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্য কিছু দেশেও। সেখানেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকেরা।
বাংলাদেশে তার প্রতিবেশী দুটি দেশ মিয়ানমার ও ভারতের বর্ডার ফোর্স দ্বারা সরাসরি মাদকসন্ত্রাসের শিকার। বাংলাদেশের তরুণ ও যুববাজারকে নিশানা করে দুটি দেশই সীমান্তের ঠিক পাশে ফেনসিডিল ও ইয়াবার কারখানা চালু রেখেছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক মদদে এই ব্যবসাকে বাংলাদেশে পুশ করছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গরু ব্যবসায়ীদের প্রায়ই ভারতীয় বর্ডার গার্ড হত্যা করে, কিন্তু এই একই বাহিনী ফেনসিডিলের বেলায় হাত গুটিয়েই শুধু রাখে না; অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশি এজেন্টদের টাকা দিয়ে কয়েক যুগ ধরে তারা বাংলাদেশে ফেনসিডিল ব্যবসা পুশ করছে। আর মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড ফোর্স বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে ব্যবসায়িকভাবে যুক্ত। আফগানিস্তানে তালেবানরা যেমন পপি চাষ করত, মিয়ানমার তেমনি করে ইয়াবার কারবার। বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আনা দরকার, শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিও জরুরি।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিবেচনায় দুর্বল বা অসচেতন দেশ যদি মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পিছিয়ে থাকে তবে শক্তিশালী প্রতিবেশীরা এভাবে তাদের বুদ্ধিহীন ও মেধাহীন করার সুযোগ নেয়। বাংলাদেশ সম্ভবত এরই শিকার হচ্ছে। এই অপতৎপরতার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মনোযোগ চাই। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও সরকারের ভেতর এ উপলব্ধি জন্মাতে হবে সবার আগে। অন্যথায় কেউই সাহায্যে এগিয়ে আসবে না।
অন্যদিকে, মাদক ব্যবসা সরকারি দলগুলোর সন্ত্রাসী, ছাত্র ও যুব শাখাকে লালনপালন করার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তিমূল। বলা যায়, উন্নয়ন বাজেট লুট, চাঁদাবাজি ও মাদক—এই তিনের ওপর ক্ষমতাসীনদের ছাত্র-যুবসহ লাঠিয়াল সন্ত্রাসী শাখাগুলো আর্থিকভাবে দাঁড়িয়ে উঠেছে। দিকদিশাহীন যুবসমাজকেই তারা টার্গেট করে তাদের অবৈধ আর্থিক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে সমাজের সর্বস্তরে। আমাদের আদর্শহীন দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদেরা ভাগাড়ের পচা মাংস খাওয়ার মতোই মাদক থেকে আসা নোংরা টাকার দিকে লোভী শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
‘বন্দুকযুদ্ধের’ ছলনার দিক
এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সত্যিকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব। দরকার সমাজের ব্যাপক মানুষের একসঙ্গে প্রতিবাদে নামা। অথচ আমরা দেখছি কী?
বছরের পর বছর ধরে পারিবারিকভাবে মাদকসাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা বদি পরিবারের (এ রকম আরও বেশ কয়েকটি পরিবার রয়েছে) লোকদের সাংসদ কিংবা সিআইপি হিসেবে মর্যাদা দিয়ে রেখে তৃণমূল পর্যায়ের কিছু ব্যবসায়ী হত্যা করা মাদকবিরোধী অভিযানের সবচেয়ে প্রতারণার দিক।
‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হচ্ছে রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। ক্রসফায়ারে বাংলাদেশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কিংবা দমন—কোনোটিই হয়নি। বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর হাতে একচেটিয়া ক্ষমতা দিয়ে তাদের জবাবদিহির বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের হাতে জমা হয়েছে একচেটিয়া ‘সন্ত্রাসের’ ক্ষমতা। ক্রমাগত ক্রসফায়ার জানান দিচ্ছে যে বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা সমাজের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এবং দমনে কোনোই প্রভাব রাখে না। একদিকে অতি দীর্ঘ কালক্ষেপণের বিচারপ্রক্রিয়া সমাজের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখে না, দমন তো দূরের কথা, অন্যদিকে বাংলাদেশের আদালত অপরাধ সংঘটনের গোড়ার কারণ বিশ্লেষণ করে সরকারকে তাদের পর্যবেক্ষণ ও রুলিং দিতে পারছে কি? রাজনৈতিক নিয়োগ ও চাপের কারণে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই অক্ষমও বটে। ফলে মাদক মাদকের জায়গাতেই থেকে বিস্তৃত হচ্ছে, পাচারকারীরা ঘুষ ও তদবির করে পার পেয়ে যাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে আঙুল ফুলে কলাগাছ। এখন সরকার রাজনৈতিকভাবে না চাইলে মাদকের বিস্তার রোধ অসম্ভব। তাই মাদক রোধে ‘শীর্ষ থেকে নিচ’ অ্যাপ্রোচ নিতে হবে, যেকোনো ‘নিচ থেকে ওপরে’ উদ্যোগ এখানে ব্যর্থ এবং লোক দেখানো।
সবশেষে আমাদের সীমান্ত এলাকার নাগরিকের বেকারত্ব কমাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির টেকসই পথ বের করতে হবে অর্থাৎ এসব এলাকার বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করতে হবে। সীমান্তে ব্যাপকসংখ্যক নাগরিককে বেকার রেখে, ব্যাপকসংখ্যক উদ্বাস্তু রেখে মাদকসহ যেকোনো পণ্য পাচার সমস্যার টেকসই সমাধানে আসা বেশ দুষ্কর বটে!
শুভ বোধ জাগ্রত হোক দিকে দিকে। তারুণ্য রক্ষা পাক, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়ন অ্যাকটিভিস্ট।
faiz.taiyeb@gmail.com