‘দিন দিন কৃষি জমি কমে আসছে—বাড়ছে ইটভাটা। ভাটার সংখ্যা আগামী তিন বছরে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এভাবে ইটভাটার সংখ্যা বাড়তে থাকলে এ উপজেলায় একদিন চরম খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। কৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপন না করার যথাযথ আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। এ কারণে দিন দিন প্রভাবশালীরা কৃষি জমিতে ভাটা স্থাপনে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। কিন্তু আমার এককভাবে করার কিছুই নেই।’ এভাবেই কথাগুলো বললেন রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান।

বদরগঞ্জে বাড়ছে ইটভাটা, কমছে কৃষিজমি। এক মৌজায় ২২, দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘেঁষে ১০

তার তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় এবার ১২০ একর জমিতে নতুন করে ১৫টি ইটভাটা স্থাপনের কাজ চলছে। গত বছর ইট পোড়ানো হয়েছে ৪৩টি ভাটায়। সব মিলিয়ে কৃষি জমিতে ইটভাটা রয়েছে ৫৮টি। একেকটি ইটভাটা ৮ থেকে ১০ একর কৃষি জমি দখল করে নিয়েছে। এতে ৫৮টি ইটভাটা ৪৬৪ থেকে ৫৮০ একর কৃষি জমির মধ্যে রয়েছে। ওই ভাটা মালিকরা ইট প্রস্তুতের জন্য বারো মাসেই মাটি সংগ্রহ করছেন কৃষি জমির টপসেল কেটে। একেকটি ইটভাটা বছরে ২০ থেকে ৩০ একর জমির টপসেল কেটে নিচ্ছেন। এতে বছরে প্রায় দেড় হাজার একর আবাদি জমির টপসেল মাটি গিলে খাচ্ছে ইটভাটাগুলো। কৃষকরা কাঁচা টাকার লোভ সামলাতে না পেরে কৃষি জমির মাটি বিক্রি করছে। জমির টপসেল কেটে নেওয়ায় ৩০ বছরও ওই জমির উর্বরতা শক্তি ফিরে আসবে না—বললেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়—উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নে ২৪টি, রামনাথপুরে ১৩টি, দামোদরপুরে ৭টি, কুতুবপুরে ৪টি, কালুপাড়ায় ৪টি, বিষ্ণুপুর, গোপালপুর ও রাধানগর ইউনিয়নে ২টি করে কৃষি জমিতে ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে নতুন ইটভাটা হচ্ছে মধুপুরে ৪টি, রামনাথপুরে ৪টি, কুতুবপুরে ২টি, বিষ্ণুপুরে ২টি, রাধানগর, দামোদরপুর  ও কালুপাড়া ইউনিয়নে ১টি করে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ অনুযায়ী, কৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। অকৃষি জমিতে ভাটা করা যাবে। তবে বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলজিইডি সড়ক থেকে ভাটার দূরুত্ব হতে হবে কমপক্ষে ১ কিলোমিটার। কিন্তু এ উপজেলায় অধিকাংশ ইটভাটা ওই আইনের মধ্যে পড়েনি। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইট পোড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

মধুপুর ইউনিয়নের নাওপাড়া গ্রামের আরিফুল হক বলেন, তার ইউনিয়নের রাজরামপুর মৌজায় গত বছর ছিল ২০টি ইটভাটা। এবার নতুন করে হচ্ছে আরো দুটি।’

রামনাথপুর ইউনিয়নের ঘাটাবিল শহীদ স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ঘাটাবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘিরে রয়েছে ১০টি ইটভাটা। ভাটাগুলোতে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়।

কালুপাড়া ইউনিয়নের জামুবাড়ি নয়াপাড়া গ্রাম ঘেঁষে কৃষি জমিতে একটি ইটভাটা রয়েছে। এবার নতুন করে বিআরবিএল নামে আরও একটি ইটভাটা নির্মাণ হচ্ছে। ওই ভাটায় ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মালিক জেলা প্রশাসকের কাছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন, কিন্তু এখনো হাতে পাননি।’

উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম খোকা বলেন, ‘আমাদের সমিতির আওতায় ৪৩টি ইটভাটা রয়েছে। গত মৌসুমে সব কয়টি ভাটায় ইট পোড়ানো হয়েছে। এবার নতুন করে ২৫টি ইটভাটা হওয়ার কথা শুনতে পেয়েছি। এখন পর্যন্ত সমিতির সদস্য হতে আমাদের কাছে ১০ জন আবেদন করেছেন। আইন অনুযায়ী দেশের কোথাও একটি ইটভাটা হয় না। তবুও ইটভাটা হচ্ছে।’

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ অনুযায়ী, ইটভাটার লাইসেন্স দিবেন জেলা প্রশাসক। লাইসেন্স দেওয়ার আগে যেখানে ভাটা নির্মাণ হবে সেখানে ভাটা করা যাবে কি না-এই মর্মে জেলা প্রশাসক কর্তৃক একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের কমিটি রয়েছে। কমিটিতে রয়েছেন, সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বা তত্কর্তৃক কোনো বন কর্মকর্তা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় বা জেলা কার্যালয় কর্তৃক মনোনীত কোনো কর্মকর্তা, যিনি ওই কমিটির সদস্য সচিব হবেন। ওই কমিটি নির্ধারিত পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করিয়া লাইসেন্স প্রদান বা নবায়নের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নিকট সুপারিশ করবেন। নিয়ম মেনে ইট পোড়ানো হচ্ছে কিনা তারা মনিটরিং করে জেলা প্রশাসককে অবহিত করবেন।

ওই কমিটির সদস্য ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাশেদুল হক বলেন, ‘আমি একটি ইটভাটার জন্যও সুপারিশ করিনি। শুনতেছি নতুন করে কৃষি জমিতে ২০-২৫টি ইটভাটা হচ্ছে। তারা লাইসেন্স পেয়ে ইটভাটা নির্মাণ করছে কি-না তা ক্ষতিয়ে দেখা হবে।’ আরেক সদস্য ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবর রহমান বলেন, ‘আমি কাউকে কৃষি জমিতে ইটভাটা নির্মাণের জন্য ছাড়পত্র দেইনি।’

এ ব্যাপারে গতকাল রবিবার দুপুরে মোবাইল ফোনে রংপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার সরকারি মোবাইল ফোন রিসিভ করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রুহুল আমিন। তিনি বলেন, ‘ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে কি-না—এই মর্মে ছয় সদস্যের কমিটি রয়েছে। কমিটি সুপারিশ করলে আমরা লাইসেন্স দিই। কমিটির সুপারিশের বাইরে কোনো ইটভাটা মালিককে লাইসেন্স দেওয়ার সুযোগ নেই।’

আপনার অভিমত