খুলনা টু গাজীপুর। দুইশ’ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব দুই সিটির। খুলনায় ভোট হয়েছিল ১৫ই মে। এর ৪০ দিন পর ভোট গাজীপুরে। তবে দুই সিটির ভোটে দারুণ মিল দেখা গেছে গতকাল। ব্যালট ছিনতাই, জাল ভোটের উৎসব আর কেন্দ্র দখলে রেখে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেয়ার চিত্র দেখা গেছে দিনভর।

খুলনার মতোই এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। নির্বাচনে অনিয়ম জাল ভোট ঠেকাতে পুলিশকে কোথাও তৎপর না দেখা গেলেও নির্বাচনী খবর সংগ্রহে থাকা সংবাদিকদের নানা অজুহাতে পুলিশ হয়রানি করেছে বিভিন্ন কেন্দ্রে। এমনকি আটক করে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। খুলনায় এক নতুন কিছিমের ভোট হয়েছিল। বাইরে দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলেও কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ ছিল পুরো নির্বাচনী এলাকায়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক বিপুল ভোটে বিএনপির প্রার্থীকে পরাজিত করেন। খুলনার মতোই গাজীপুরে দিনভর শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। বড় কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। তবে সকাল থেকেই বিএনপির প্রার্থী অভিযোগ করতে থাকেন তার এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও এজেন্টরা কেন্দ্রেই যেতে পারেননি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন অভিযোগ বাড়তে থাকে। সকালে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা থাকলেও দুপুরের পর থেকে তা কমে যায়। কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ আসতে থাকে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে। নির্বাচন চলাকালে বিএনপির নেতাকর্মীদেরও কেন্দ্রের আশেপাশে খুব একটা দেখা যায়নি। যেসব কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়েছে ওইসব কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের কোনো উপস্থিতি ছিল না। নির্বাচন চলাকালে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিনিধি দল নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়টি ইসিকে অবহিত করেন। সেখান থেকে বের হয়ে বিএনপি নেতারা জানান সিইসি তাদের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই বিকালে নির্বাচন শেষ হয়। দিনভর নির্বাচনের মাঠে থাকা বিএনপির প্রার্থী ভোট শেষে সাংবাদিকদের জানান, ৪২৫ কেন্দ্রের মধ্যে চার শতাধিক কেন্দ্রেই দখল-অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। যা গাজীপুরে ৮০ বছরের ইতিহাসে আর হয়নি। এদিকে অনিয়মের কারণে নয়টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেয় নির্বাচন কমিশন। এই নয় কেন্দ্র ছাড়া অন্যসব কেন্দ্রে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে দাবি ইসির। ভোটার উপস্থিতি কম থাকায় নির্বাচনে ৫৫ থেকে ৬০ ভাগ ভোট পড়তে পারে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে।

রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের চেয়ে বিপুল ভোটে এগিয়ে ছিলেন। নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ দাবি করে আওয়ামী লীগ বলেছে, সরকারের উন্নয়ন কাজের ফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিপুল ভোট পেয়েছেন। আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার আগে সন্ধ্যায় দলীয় সভানেত্রীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিপুল ভোটে দলীয় প্রার্থীর জয়ের আশা প্রকাশ করে এ মন্তব্য করেন।

এদিকে আমাদের প্রতিনিধিরা নির্বাচনী এলাকায় দিনভর অবস্থান করে যে তথ্য দিয়েছেন তার ভিত্তিতে মোটামুটি প্রায় সব কেন্দ্রেই কোনো না কোনো অনিয়মের চিত্র ধরা পড়েছে। সকালে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ শুরু হলেও অনেক কেন্দ্রে বিএনপির কোনো এজেন্ট খোঁজে পাওয়া যায়নি। দায়িত্বরত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জানান, এজেন্টদের কেউ কেউ এসে চলে গেছেন। আবার কোনো কেন্দ্রে এজেন্ট আসেননি। কিছু কেন্দ্রের সীমানার মধ্যেই দলীয় কর্মী-সমর্থকদের জটলা দেখা যায়। সরজমিন পরিদর্শনের সময় কিছু কেন্দ্রের বুথে ভোটার নন এমন ব্যক্তিদের নৌকা প্রতীকে সিল মারতে দেখা যায়। এ ছাড়া ভোট দিতে আসা কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন তারা কাউন্সিলর পদের দুটি ভোট দিতে পারলেও মেয়র পদে তাদের ভোট দিতে দেয়া হয়নি। কাউকে কাউকে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়। বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে পরস্পর বিরোধী অবস্থান দেখা যায়। কিছু কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। ভোট দিতে আসা ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন লাইনে দাঁড়ালেও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে তাদের বুথ পর্যন্ত যেতে হয়। আবার কিছু কেন্দ্র দুপুরের পর থেকে ফাঁকা দেখা গেছে। জয়দেবপুর এলাকার একটি কেন্দ্রে বিকালে কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীর সামনেই জাল ভোট দেয়ার দৃশ্য দেখা যায়। যে ছয়টি কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা হয় তাতে ভোট গ্রহণের গতি ছিল খুবই শ্লথ।

এই ফল সরকারের উন্নয়নের ফসল: কাদের
গাজীপুরের আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচনের ফলকে সরকারের উন্নয়নকাজের ফল বলে মন্তব্য করেন। বিকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, খুলনার ফলাফল এবং গাজীপুরের শুরুটা এভাবে দেখছি। একে আমরা বড় বিজয়ের আশার প্রহর গুনছি। এটা আমি এক কথায় বলব, শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়ন ও অর্জনের সোনালি ফসল এই রেজাল্ট। তিনি দাবি করেন, বিএনপি ছাড়া এই নির্বাচন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। নির্বাচনে সহিংসতার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এতেই প্রমাণ হয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ১০০টি কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, জিসিসি নির্বাচন নিয়ে নয়া পল্টন কার্যালয় এবং গাজীপুর সকাল থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে। মূলত এর কোনো ভিত্তি নেই। পুরনো এবং মুখস্থ কিছু কথা তারা অতীতের মতো আজকেও বলেছে। তাদের এজেন্টরা যদি নাই আসে তাহলে কী করে তাদের বের করে দেয়া হয় এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। নির্বাচন কমিশন সরকারের সঙ্গে মিলে প্রতারণা করছে- বিএনপির এমন অভিযোগের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, এ নির্বাচনে গণতন্ত্র প্রতারিত হয়নি, গাজীপুরের মানুষ প্রতারিত হয়নি, বিএনপি এ ধরনের নেতিবাচক কথাবার্তা বলতে থাকলে ভবিষ্যতে তাদের ভোট আরো কমবে।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে: ইসি
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, গাজীপুরের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। নিজস্ব পর্যবেক্ষক দিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। ৪২৫টির মধ্যে ৯টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে। এই ৯টি কেন্দ্রে অচিরেই নির্বাচন হবে। আমাদের নির্দেশ ছিল কোনো কেন্দ্রে অনিয়ম হলে তা বরদাশত করা হবে না। প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ন্যূনতম অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এসব কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করে দিই। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, বিএনপি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেছে। তাদের অভিযোগের ব্যাপারে আমি কোনো কিছু জানি না। জাল ভোটের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে হেলালুদ্দীন বলেন, এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।

ইসিতে বিএনপি: সরকার যেভাবে চেয়েছে, সেভাবে ইসি সাজানো নির্বাচন পরিচালনা করেছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু। দুপুরে নির্বাচন চলাকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। সেখান থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বুলু। তিনি বলেন, সাজানো নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছে। তাঁরা আপাতত আর কোনো অভিযোগ জানাতে চান না। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসি কোনো অভিযোগেই ব্যবস্থা নেয়নি। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ শুধু আজকে না, শুরু থেকেই করে আসা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা ইসির কাছে অভিযোগ জানাই, জবাব দেন এইচ টি ইমাম ও ওবায়দুল কাদের।
উল্লেখ্য, আয়তনের দিক দিয়ে দেশের বৃহৎ গাজীপুর সিটির ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৭জন মেয়র, ২৫৪ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৮৪ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭শ’ ৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩৫ এবং নারী ভোটার ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১। নির্বাচনে ছয়টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম এ ভোটগ্রহণ করা হয়। এ ছয়টি কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।

আপনার অভিমত