কেন ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে? নিরস্ত্র হাতে ছিনিয়ে নেয়া নিজেদের ভূমিতে কেন তারা ফিরে যেতে চায় যখন ওই ভূমি থেকে ইসরাইলি স্নাইপাররা তাদের বুকে গুলি চালিয়ে অশ্লীল রসিকতা করতে থাকে, আর নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও কেন ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদে নির্ভয়ে এগিয়ে যায়। নিজেদের ভূমিতে যখন ফিলিস্তিনিরা নামাজে সেজদারত থাকে তখনো ইসরাইলি ঘাতকদের গুলি এসে তাদের ঘায়েল করে, ইউটিউবে তা ভাইরাল হয় আর উল্টো তারাই কি না সন্ত্রাসী, অন্তত পশ্চিমা মিডিয়ার একটি অংশ তাই বলে। গত কয়েক দিনে নাকবা অর্থাৎ বিপর্যয়ের স্মরণে গাজায় যখন ফিলিস্তিনিরা এ ধরনের প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাতে থাকে তখন তাদের ওপর গুলি ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে ইসরাইলি সেনারা। ৮৫ জন তরুণ, শিশু এমনকি তরুণী নিহত হয়েছে আর ইসরাইলিদের ভাষায় এরা সবাই হামাস সদস্য। দুই সহস্রাধিক আহতদের মধ্যে রয়েছে চিকিৎসক, সাংবাদিক কিন্তু একজন ইসরাইলি এসব ঘটনায় সামান্য আহত হয়নি। এরপরও গণহত্যার জন্য গাজাবাসীকে দায়ী করে হোয়াইট হাউজের উপ-প্রেসসচিব রাজ শাহ বলেছেন, হামাসের বিােভ কর্মসূচিতে ফিলিস্তিনিরা অংশ নেয়ার কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হামাস উসকানি দিয়েছে। ইসরাইলের আত্মরার অধিকার আছে।
শুধু একটি ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে ধরে রাখার জন্য একজন বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করে তারা। হুইল চেয়ারে পঙ্গু প্রতিবাদকারী রেহাই পায়নি। আহতদের সেবা করছে এমন চিকিৎসককে মেরেছে তারা। হত্যা করেছে সাংবাদিককেও। গাউন পরা চিকিৎসক কিংবা প্রেস লেখা জ্যাকেট পরিহিত পেশাজীবীদের গুলি করে তারা হত্যা করেছে এবং বলছে তারা হামাস সন্ত্রাসী ও আত্মরক্ষার অধিকার তাদের রয়েছে। কোনো আন্তর্জাতিক আইনের বালাই নেই এখানে।
পশ্চিত তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলিদের ইচ্ছায় চলাফেরা করে মাত্র। গাজা বিশ্বে সর্ববৃহৎ এক কারাগার। চার দিকে কাঁটাতারের বেড়া অথবা কংক্রিটের উঁচু দেয়াল। প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা কোনো না কোনো চেকপয়েন্টে কাজ করতে যাওয়ার সময় বা কলেজে পড়তে গেলে ফিলিস্তিনিদের তল্লাশি ও অপদস্তের শিকার হতে হয়। ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব ভূমিতেই তারা এখন ইসরাইলি সামরিক দখলদারিত্বের শিকার। তাদের কোনো মৌলিক অধিকার নেই। এক সর্বাত্মক দুঃস্বপ্ন ঘিরে থাকে তাদের চার পাশ। ফিলিস্তিনি মাত্রই যেন সন্ত্রাসী। চাইলেই ইসরাইলি বুলড্রোজার এসে যেকোনো ফিলিস্তিনির বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়, জলপাই বাগান আগুনে পুড়িয়ে দেয়, গভীর রাতে বাড়ি ঘেরাও করে গলা ধাক্কা দিয়ে ফিলিস্তিনিদের বের করে দেয় যেখানে তারা শত শত বছর ধরে বাস করে আসছে বংশপরস্পরায়। ফিলিস্তিনিদের বসতি উচ্ছেদের পর উচ্ছেদ করে একের পর এক ইসরাইলি শহর গড়ে উঠছে। এরপরও পশ্চিমারা বুঝতে পারে না কেন একজন ফিলিস্তিনি শিশু ইসরাইলি ট্যাংকের দিকে পাথর ছুড়ে মারে। একটি শিশুর মনেও কী পরিমাণ হতাশা, দুর্দশা ও আশাহতের বেদনা জড়িয়ে থাকে যে এধরনের প্রতীকী প্রতিবাদে সে নিশ্চিত মৃত্যুকে পরোয়া না করে তীব্র এক মানসিক যন্ত্রণাকে আড়াল করার চেষ্টা করে। ইসরাইলি বিমানের বোমা বর্ষণে ফাদি আবু সালাহ দুই পা হারানোর পরও হুইল চেয়ারে বসে তাই প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন। ইসরাইলি স্নাইপাররা তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। এরপরও ইসরাইল নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ বলে দাবি করে। ফিলিস্তিনি তরুণ, তরুণী, পঙ্গু, বৃদ্ধ ও শিশুদের গুলি করে গণতান্ত্রিকভাবে হত্যা কিংবা নিশানা অনুশীলন করে!
ঠাণ্ডা মাথায় এ ধরনের ধীরগতির গণহত্যা চলে আসছে ১৯৪০ সাল থেকে। ১৯৪৮ সালে নাকবা বা বিপর্যয় শুরু হয় আট লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়ি ঘর থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা এ ধরনের ফিলিস্তিনের সংখ্যা ৬০ লাখে পৌঁছেছে। ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যদি শান্তি চাইত তাহলে দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাকে তারা ছুড়ে ফেলল কেন? জাতিসঙ্ঘের ১৮১ নম্বর প্রস্তাবনা অনুযায়ী জেরুসালেম জাতিসঙ্ঘের অধীনে থাকার কথা। ফিলিস্তিনি ভূমি দখল কেন থামাচ্ছে না সম্প্রসারণবাদী ইসরাইল। কারণ ম্যাকিয়েভেলির সেই সমাধান, যারা তোমার শত্রু তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাও। তাদের ভূমি ও সম্পদ দখল অব্যাহত রাখ, যা সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য। শত্রুকে সন্ত্রাসী অ্যাখ্যা দিয়ে জোরেশোরে নিজেদের আত্মরক্ষার কথা প্রচার কর। নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসী অ্যাখ্যা দিয়ে এই আচরণই তো করছে ইসরাইল।
জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস খোলার দিনে পশ্চিমা মিডিয়া ট্রাম্পের অজ্ঞতা প্রচার করে, যখন তিনি জেরুসালেমে তার দেশের দূতাবাস খোলার দিনটিকে ঐতিহাসিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। রঙিন পোশাক ও দামি মদ হাতে নিয়ে যখন জেরুসালেমে পার্টিতে নারী-পুরুষরা নৃত্যে মেতে ওঠেন তখন মাত্র ৬০ মাইল দূরেই গাজা সীমান্তে ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরতে থাকে। হাসপাতালগুলো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আহতদের চিৎকারে। তুরস্ক যখন আহতদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন জানায় তা প্রত্যাখ্যান করে মিসর ও ইসরাইল। বিদ্যুৎ নেই, বিশুদ্ধ পানির অভাব, সার্জনরা দিন-রাত ফিলিস্তিনিদের বাঁচাতে দৌড়ঝাঁপ করে। সঙ্গত কারণেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন, মুসলিম দেশগুলোর উচিত ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। এরদোগানের মুখপাত্র ইব্রাহিত কালিন বলেছেন, ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান না হলে সেখানে কারো জন্য কোনো শান্তি-নিরাপত্তা-সমৃদ্ধি আসবে না। ইসরাইলের আইন লঙ্ঘন করা ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধে অবশ্যই মুসলিম দেশগুলো, ইউরোপ, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তুরস্ক দেশটিতে ইতোমধ্যে ইসরাইলি পণ্য প্রবেশে বিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এ দিকে, মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা এক যৌথ বিবৃতিতে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য জাতিসঙ্ঘের অঙ্গ-সংগঠন নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ, মানবাধিকার পরিষদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। যা প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি সেনাদের নৃশংস গণহত্যার পর ওআইসির জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে জেরুসালেমে দূতাবাস স্থানান্তর মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত এবং জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করা হয়। ফিলিস্তিনিদের জন্য আন্তর্জাতিক সুরা বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে ওআইসি।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান যেইদ রা’দ আল হোসেইন বলেছেন, ফিলিস্তিনের গাজা সীমান্তে ইসরাইলের হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক নিরপে তদন্ত হওয়া উচিত। অনেক মুসলিম দেশের নেতারা বলছেন, মুসলমানরা সোচ্চার না হলে মক্কা ও মদিনাও দখলে নেবে ইসরাইল। প্রেসিডেন্ট এরদোগান এও বলেছেন, ইসরাইলি হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতায় কার্যকর পদপে নিতে ব্যর্থ হওয়ার মধ্যে দিয়ে জাতিসঙ্ঘ ভেঙে পড়েছে। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। ভালো বন্ধুত্ব থাকার পরও জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না বলে তিনি জানান। ফিলিস্তিনিদের প্রতি তুরস্কের সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা বলে তিনি আরো বলেন, বিশ্বের অন্য কোথাও এমন হত্যাযজ্ঞ ঘটলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেক বেশি সক্রিয় হতো।
এদিকে বসনিয়া সফরের সময় এরদোগানকে হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়ার দাবি করেছে দেশটির সরকারি বার্তা সংস্থা আনাদোলু। তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত করেছে তুরস্কের একটি গোষ্ঠী তাকে যে হত্যার পরিকল্পনা নেয় তা মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপজি থেকে কয়েকজন তুরস্কের নাগরিক অবহিত করে। এ ছাড়া, পশ্চিমা কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা তুরস্কে এ ধরনের হত্যা পরিকল্পনার কথা জানায়। তুরস্ক সরকারের মুখপাত্র বেকির বোজদাগ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট এরদোগান ভীত নন এবং তার বিশ্বাস থেকে কখনো বিচ্যুত হবেন না। সম্প্রতি ইসরাইলের এক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তার একটি বইতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতাদের গোপনে হত্যার জন্য তার দেশ যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত তা তুলে ধরেন।

আপনার অভিমত